- সুদামা পাণ্ডে 'ধূমিল'
...........................................................
|
Image courtesy: Google |
বাটালি থেকে চোখ তুলে আমাকে এক মুহূর্ত দেখলো
ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত
আর তারপর মৃদু স্বরে হেসে বললো ―
বাবু, সত্যি কথা বলি ―
আমার চোখে কেউ ছোট নয়
কেউ বড়োও নয়
আমার কাছে প্রত্যেকটা মানুষ যেন আদতে এক জোড়া জুতো
যারা আমার সামনে অপেক্ষা করে আছে জরুরী মেরামতের জন্যে।
আর আসল কথা কী জানেন?
যে যেমনই হোক, যেখানেই থাকুক
আজকাল কোনো মানুষই জুতোর মাপের বাইরে নয়
তবুও আমি সবসময় মনে রাখি যে
পেশাদারী হাত আর ফাটা জুতোর মধ্যেখানে,
কোথাও না কোথাও একটা আদত মানুষ লুকিয়ে আছে
যার শরীর- মনের ওপর দিয়ে সেলাই এর ফোঁড় চলে
যে ফাটা জুতোর কোন থেকে উঁকি মারা কড়ি আঙ্গুলে লাগা আঘাত
নিজের বুকে হাতুড়ির ঘা এর মতো করে সহ্য করে।
অনেক রকম জুতো আসে আমার কাছে
তারা আমাকে নানা রকম মানুষের গল্প শোনায়
ওরা আমাকে বলে, প্রত্যেকটা মানুষের আলাদা চেহারা
আর সবার আলাদা আলাদা ধরণ!
যেমন ধরুন, এমন এক জোড়া জুতো নিয়ে এলো কেউ
যাকে ঠিক জুতোও বলা যায় না -
যেন কিছু চাকতির একটা মোটা থলি!
তাকেও কোনো কোনো মানুষ পায়ে দেয় কিন্তু
সেই মানুষ যাকে গুটিবসন্ত খুঁটে খুঁটে খেয়েছে
সেই মানুষের জীবনে আবার আশা আকাঙ্খা -
যেন টেলিফোনের পোস্টে আটকে থাকা
ফড়ফড় শব্দে ঘুড়ির উড়ান!
আমি বলতে চাই তাকে ―
"কেন যে পয়সা জলে ফেলবে, বাবু?"
কিন্তু আমার আওয়াজ কাঁপে
আমি বুঝতে পারি ― ভেতর থেকে যেন কেউ বলে ওঠে
"তুই কি রকম মানুষ রে? নিজের পেশার ওপর থুতু ফেলিস্?"
বিশ্বাস করুন
সেই সময় আমি ওই চাকতিগুলোর জায়গায়
নিজের চোখ সেলাই করি -
আর নিজের পেশায় আটকে থাকা এই মানুষটাকে
কোনোরকমে সহ্য করি!
আরেক জোড়া জুতো আসে কখনো কখনো -
যা দিয়ে পা সাজিয়ে, মানুষ বিকেলে ঘুরতে বেরোয়
সেই মানুষ বুদ্ধিমানও নয়
সময় নিয়ে সচেতনও নয়
তার চোখ ভর্তি শুধু লোভ
আর আছে হাত ঘড়ি
তার যাবার কোথাও নেই
কিন্তু তাড়াহুড়ো সারা শরীরে
স্বভাবে সে এক্কেবারে ব্যবসায়ী
বা সওদাগর
কিন্তু কায়দা এমন, যেন হিটলারের নাতি!
"এটা বাঁধো, ওটা কাটো, এখানে ঠোকো, ওখানে মারো
ঘষে দাও, আরো চকচকে করো
জুতোটাকে এমন করে দাও যেনো ...
উফঃ! বড্ডো গরম বাবা!"
রুমাল দিয়ে হাওয়া করতে থাকে নিজেকে
প্যাচপ্যাচে গরমকে গোটা চারেক গালি দিতে দিতে
রাস্তার এ জাতি, সে জাতির লোকেদের
বাঁদরের মতো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে!
মোদ্দা কথা হলো, পাক্কা একটি ঘন্টা খাটিয়ে নেয়
কিন্তু পয়সা দেবার সময় হলেই,
বেমালুম মাথা নেড়ে এড়িয়ে যায়!
বলে, "ভদ্রলোক পেয়ে ডাকাতি করছো!"
তাড়াতাড়ি কয়েকটা সিকি ফেলে এগিয়ে যায়
আর কয়েক পা এগোতে না এগোতেই
চিৎকার করে লাফিয়ে ওঠে!
আসলে কেউ যখন পেশার ওপর আঘাত করে
তখন একটা না একটা ছোট চোরা পেরেক
জুতোর মধ্যে লুকিয়ে রয়ে যায়
আর সুযোগ পাওয়া মাত্র
ফুটে যায় আঙুলে ।
কিন্তু তার মানে এই নয় যে আমি কোনো ভুল ধারণা নিয়ে বেঁচে আছি
আমি সবসময় মনে রাখি যে,
জুতো আর আমার পেশাদারী হাতের মধ্যেখানে
কোথাও না কোথাও এক আস্ত মানুষ আছে
যার ওপরে নিত্য সেলাইয়ের ফোঁড় পড়ে
আর যে জুতো থেকে উঁকি মারা আঙুলে লেগে যাওয়া চোট
নিজের বুকে
হাতুড়ির ঘা এর মতো বয়ে চলে।
আর বাবু, আসল কথা কি জানেন -
বেঁচে থাকার পিছনে যদি কোনো কারণই না থাকে
তাহলে নামাবলী বেচে বা বেশ্যাদের দালালী করে
টাকা রোজগারের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
আর ঠিক এই জায়গাটাতেই প্রত্যেকটা মানুষ
নিজের পেশাকে পেছনে ফেলে
ভিড়ের মধ্যে মিশে যায় ।
সব মানুষের মতো ভাষা ওকেও ছিঁড়ে খায়
শীত গ্রীষ্ম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারে
আপনি এই বসন্ত ঋতুর কথাই ধরুন না কেন,
বসন্ত এই দিনগুলোকে এমন টেনে টুনে বিছায়
যেন কোনো তাঁতের ওপর খাটিয়েছে -
আর ওই দেখুন,
গাছের ওপর হাজার হাজার লাল লাল পাতার বাহার
যেন রোদে শুকানোর জন্যে রেখে দিয়েছে
সত্যি বলছি ―
সেই সময় বাটালিকে মুঠোর মধ্যে ধরে কাজ করে যাওয়া ভারী মুশকিল
চোখ কোথাও চায় -
আর হাত যায় অন্য কোথাও ।
কোনো গোমড়া মুখো বাচ্চার মতোই তখন
কাজে আসতে এক্কেবারে রাজী হয় না আমার মন।
আমার কি মনে হয় জানেন?
এই ভদ্র সভ্য চামড়ার পেছনে
যেন একটা আস্ত জঙ্গল লুকিয়ে আছে
যা গাছকে হাতিয়ার বানিয়ে
অত্যাচার করে চলে মানুষের ওপরে
আর এটা শুনে চমকে ওঠার কিছু নেই,
এটাও একটা ভেবে দেখার মতো বিষয়!
কিন্তু, জীবনকে যারা শুধু বই দিয়ে মাপে
সত্যি আর অনুভূতির মধ্যেখানের
কোনো রক্তাল্প দুর্বল মুহূর্তে সেই ভীরু-কাপুরুষ মানুষ
হয়তো খুব সহজেই বলে উঠবে
"বন্ধু, তুই মুচি না! তুই কবি!"
আসলে সে এক জব্বর ভুল ভাবনার শিকার
সে ভাবে মানুষের পেশাই জাতি নির্ধারণ করে
আর ভাষার ওপর মানুষের নয়,
যেন কোনো জাতির অধিকার থাকে !
যখন কী না আসল কথা হলো
আগুন সবাইকেই জ্বালায়,
সত্যি সবার ভেতর দিয়ে সমান ভাবে বয়ে চলে
কেউ কেউ সেই সত্যি বলার শব্দ খুঁজে পেয়েছে
আর কেউ কেউ অক্ষরের সামনে এখনো অন্ধ!
তারা সব অন্যায় চুপচাপ মেনে নেয়,
পেটের আগুনকে ভয় পায় -
যদিও আমি জানি "একটা 'না' বলে চিৎকার"
আর "একটা বুঝদার চুপ"
দুটোর আদতে একই মানে -
কেননা ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে, "চুপ" আর "চিৎকার"
নিজের নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে,
নিজেদের ভূমিকা পালন করে চলে।
original: http://bolbihar.in/2017/07/09/mochiram-a-poetry-by-dhoomil/